কলমে -সাম্য শফিক
প্রত্যেকটা মানুষের মন একেকটা রঙের ক্যানভাস। আকাশের মতো বিস্তৃত। ইচ্ছেরা সে ক্যানভাসে নিজের মতো করে রঙের পেখম মেলে।
কেউ রংতুলির আঁচড়ে কথা বলে। কেউ নাচে, তার শরীরি ভাষায়। কেউ নাচাতে ভালোবাসে। কেউ অভিনয় করে, কেউ লেখে, কেউ পড়াশুনাকরে। কেউ গান গায়, কেউবা সুরের ছন্দে বাজনা বাজায় । কেউ বসে দর্শক আসনে, শান্তি পায় সুরের মূর্ছনায়। এরকম হাজারো ইচ্ছে অভিলাষ প্রকাশ পায় মনের ক্যানভাসে। আসলে মানুষের মন একেকটা রঙিন রঙ্গমঞ্চ।
আঁকাআকি, নাচানাচি, অভিনয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী। কবিতা বা শিল্প সংস্কৃতি। এসবের যথার্থ অর্থ থাকে। থাকে নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, প্রকাশ পায় শৈল্পিকতা । সেসব সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম বুঝার জন্য দর্শক হিসাবে-ও থাকতে হয় বিচক্ষণতা।
যদিও সবার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সমন নয়। আমাদের অজ্ঞতাবশত করণে মাঝেমধ্যেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে তৈরি করে ফেলি বিবাদ। সে বিবাদ কখনো কখনো তৈরি করে দেয় দ্বৈরথ। কখনো ভাষার ব্যবহার নিয়ে, কখনো বিষয়বস্তু নিয়ে কখনোবা সংস্কৃতি – অপসংস্কৃতি বা অশ্লীলতা ধোঁয়া তোলে। জাত গেলো, জাত গেলো বলে। স্বার্থান্বেষী মহল ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে সে আগুনে ঘি ঢালে।
ফায়দা লুটতে প্রথমে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। তারপর রাজনীতিকীকরণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপঃ পাঠ্যপুস্তকে শরীফ-শরীফার গল্প অথবা রূপান্তর নাটক নিয়ে। নেটিজেন নামক আমরা অতি আধুনিক দর্শক তৈরি হয়ে গেছি। কোন বিষয়বস্তু ভালোভাবে না দেখে, না জেনে অথবা না বুঝে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় করে ফেলছি।
ইতোমধ্যে নতুন একটা শব্দ আমদানী-ও করা হয়ে গেছে। “বয়কট” পান থেকে চুন খসলেই সে শব্দ সমস্বরে মুড়িমুড়কি মতো ফোটে। আদতে আজও আমরা হরিবোল বাঙালি হয়েই পড়ে আছি। হুজুগে নাচছি। গানের ভাষায় যদি বলিঃ
হাসছি মোরা ঢাকতে যেনো অক্ষমতা আসলে।
হিজরা হয়ে মুজরা নাচছি সূর্য ঢাকছি আঁচলে।
এদেশে কত-শত সমস্যা আছে। দূর্নীতি, ধাপ্পাবাজি আর লুটতরাজের অস্বস্তি, অস্তি মজ্জায় মিশে আছে। শিক্ষা, চিকিৎসা সহ কতো রকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় গুলো আজ বানিজ্যে পরিনতি হয়েছে। ব্যয় হ্রাস বা অবৈতনিক করা নিয়ে কোনো রাশব্দ নেই। মাতম যতো মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে। নববর্ষের উৎসবে আলপনা আঁকাআকি নিয়ে। উৎকন্ঠা জাগে মনে। অপসংস্কৃতির ধোঁয়া তুলে সাম্প্রতিকতা বিষবাষ্প ছাড়ে।
আমরা একসময় ঘেটুপুত্র কমলা দেখেছি। আমার জানামতে কারোর টুঁশব্দ শুনেছি বলে মনে পড়ে না।
যদি-ও আলোচনা-সমালোচনা আমাদের সমাজে নতুন চর্চা নয়। আবহমানকাল থেকে আছে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ব্রিটিশ হয়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। সর্বশেষ পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ। আমরা বহু ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে, ধর্মান্তরিত হতে-হতে আজ সবে নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছি। নিজ জ্ঞানে কতোটুকু অনুধাবন করার সক্ষমতা অর্জন করতে শিখেছি। মনের সংকীর্ণতার কারণেই ঠুনকো বিষয়ে মাতামাতির অভ্যাস বহুকালের।
তাই তো লালন সাঁই জি সেসময়ে বলেছেনঃ
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রুপ
দেখলাম না এই নজরে।
বাকিটা লিখতেও ভয় হয়। কখন না কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে। অনুভূতি-টুনুভূতি আদৌও কি আছে। না-কি সব কুসংস্কারে ছেয়ে গেছে।
বহুকালের এ বাউলতত্ত্ব গান নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে অরাজকতা।
সমাজ, রাষ্ট্র সহনশীল না হলে, জাতিগতভাবে বিপর্যয় অনিবার্য।
এহেন পরিস্থিতিতে আর কতোটুকুই ভালো কিছু আশা করা যেতে পারে।
বহুজাতিক ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার কারণে আমরা নিগৃহীত হয়েছি। নিগৃহীত মানসপটের আস্থা সংকটের বাঙালি মুসলমান আমরা। একটুতেই ঘাবড়ে যাই। ধর্মীয় বিশ্বাস কচু পাতায় জমে থাকা টলটলে শিশির বিন্দুর মতো। একটু নাড়া পড়লেই যেনো ঢলে পড়ে।
আমার অনেকটা পরশ্রীকাতর-ও বটে। বিদেশীয় ভাষা সংস্কৃতি খুব আকৃষ্ট করে। ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি হয়ে বর্তমানে আরবি। বুঝি বা না বুঝি আমরা এরাবিয়ান ভাবি। বাঙালি হিসেবে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আমাদের ঐতিহ্য গুলো আগলে রাখা দরকার। রংতুলির আঁচড়ে আধুনিকায়ন হলে দোষের কি ? নতুনদের জন্য, পুরাতন ঐতিহ্যে রংতুলির আঁচড়ে উজ্জীবিত হোক। নতুনত্ব নিয়ে, নতুন দের মাঝে। ৭১ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে আসুক। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি স্বত্বার পুনর্জাগরণ হোক।